Akkhoy Mulberry hardcover book in focus

“অক্ষয় মালবেরি”- শৈশবের এক সরল স্বীকারোক্তি

আকবর আলী খানের আত্মজীবনীমূলক বইতে উল্লেখ্য করেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডব্লিউ এইচ অডেন (W. H. Auden) এর বরাত দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘Every autobiography is concerned with two characters : Don Quixote, the Ego and a Sancho Panza, the Self.’ বিখ্যাত স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক স্যারভান্টিসের (Cervantes) উপাখ্যান ডন কিহটিতে দু’টি প্রধান চরিত্র রয়েছে। উপাখ্যানের নায়ক হলেন ডন কিহটি (Don Quixote)। তিনি আত্মগরিমায় বিভোর। তিলকে তাল করে দেখেন, যা কিছু করেন তার কাছে। তাই মনে হয় অসাধারণ। পক্ষান্তরে তার অমাত্য সাঙ্কো পাঞ্জা (Sancho Panza) একেবারেই সাদামাটা মানুষ, অতিরঞ্জন তার ধাতেই নেই। যা সাধারণ মানুষের কাছে সত্যি বলে মনে হবে, সেটাই তিনি বলেন। আত্মজীবনীকার তাই একই সঙ্গে ডন কিহটি ও সাঙ্কো পাঞ্জার সমাহার। তিনি ডন কিহটির মতো নিজের অর্জনের ঢাকঢোল পেটাতে ব্যস্ত।তিনি অনেক সময় সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে এসে সত্য কথা লেখার চেষ্টা করেন। অতিরঞ্জন ও সত্যের সংমিশ্রণে আত্মজীবনী রচিত হয়।”

Collected form “goodreads”

অক্ষয় মালবেরিতে মণীন্দ্র গুপ্ত নিজের অতিরঞ্জিত ও সত্যের সংমিশ্রণে আত্মজীবনী লিখেছেন কিনা তার থেকে বলা যায়,নিজের শৈশবের একটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন কেবল। বাল্যকালে তার জীবনের চড়াই-উতরাই,শৈশবের কোতুহল,জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন, তারই কেবল স্মৃতিচারণ করে গিয়ছেন কবি তার ক্যাবিক চিন্তাধারায়।এতে তার আত্মজীবনী কি কোন গরিমা এনেছে কিনা তার বাস্তব জীবনে এর থেকে বড় কথা লেখকের স্মৃতিচারণে ১৯২০ দশকের মাঝামাঝি  হতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যন্ত যে সময়কালে এক বাংগালী ছেলের জীবনসংগ্রাম,জীবনের উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে এই বইতে।

আমার মতে প্রতিটি আত্মজীবনীই সেই সময়কার ইতিহাসও বহন করে,সেই সময়ের সমাজকেও দেখতে সাহায্য করে।কবি মণীন্দ্র গুপ্তের জন্ম অখণ্ড ভারতের বরিশালে,তারপর কিশোর বয়স কেটেছে আসামে,চাকরি জীবন কলকাতা হতে ২য় বিশ্ব যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে লাহোরে প্রশিক্ষণে যোগাযোগ করে।তার আত্মজীবনীতে এইসকল স্থানের কাটানো অভিজ্ঞতায় রয়েছে ২২ বছর বয়স পর্যন্ত উনার শৈশব থেকে তরুণ হওয়া পর্যন্ত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সমারোহ নিয়ে।

উনার আত্মজীবনী তিনটি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল,প্রথম খন্ড উনার শিশুকালের বরিশালের জীবন,২য় খন্ডে উনার আসামের বয়াক উপত্যকায় জীবন এবং তরুণ বয়সে উনার কলকাতা হতে লাহোরের সেনানিবাসের যাত্রা।লেখকে অনেকেই বলেছিলেন উনার ২২বছর বয়সের পরের গল্পগুলোকেও জানাতে,তবে উনি বলেছেন উনার শৈশব ২২বছর পর্যন্ত গড়িয়েছে,সে সময়ে নিজের পরিবর্তনকে দেখেছেন।উনি কেবল উনার দীর্ঘায়িত ২২বছরের শৈশবেই জানাতে চেয়েছেন।

“অক্ষয় মালবেরি” তথা আমি সব আত্মজীবনীকে ইতিহাসের বর্ননা বলি কেননা,সেই লেখকের জীবন জড়িয়ে থাকে সে সময়ের প্রকৃতি,সমাজ,অর্থনৈতিক,ভৌগলিক পরিবেশের সাথে।তাই লেখকের জীবনের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে এক ক্যাবিকভাবে ইতিহাসের দর্শনও আমরা পেয়ে যাই।

প্রথম খন্ডে লেখকের শৈশবের গল্পে আমরা জেনেছি সেই ১৯৩০ দশকের বরিশালের তথা গ্রাম বাংলার প্রকৃতির বর্ননা,কবির দৃষ্টিতে আমরা সেই সময়কার প্রকৃতি দেখেছি,উনি প্রকৃতিকে যে দৃষ্টিতে দেখেছেন তা তুলে ধরেছেন।

দ্বিতীয় খন্ডে কিশোরকালের স্মৃতিতে আমরা দেখেছি,উনি প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের চরিত্রকেও বিশ্লেষণ করছেন,উনার মানুষকে দেখার-বুঝার দৃষ্টিকোণে।যেন এক শিশুর চোখে দেখা দুনিয়া আমরা আবার নিজের মতো করে দেখছি।

“পরিণত বয়সে দিদির স্বামী মারা গেলেন। নিরাভরণ নিভৃত নিরাসক্ত মানুষটি কোনো রোগে ভোগেন নি, কাউকে কষ্ট দেন নি। বাড়িটিতে শুধু যেন একটু শীতের বাতাস বয়ে গেলো- উঠোনের পেয়ারা গাছের কিছু পাতা ঝরে পড়ল, এক মহিলার পাকা চুল থেকে সিদুরচিহ্ন মুছে নিল, তাঁর শাড়ির পাড়টিকে সাদা করে দিয়ে হাওয়াটুকু চলে গেল।”
এই বইতে আমার প্রিয় একটি অংশ,এক মানুষের প্রয়াত হয়ে যাওয়াটাকে,তার শূন্যতাকে এক ক্যাবিক আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

এই ২য় অংশেই উনার সাহিত্যের সাথে পরিচয় হয়,সেই সময়ের বই পত্রিকা,চিত্রশিল্প থেকে বিনোদনের জন্যে সার্কাস,বিভিন্ন ধর্মীয় অচার-অনুষ্ঠান পালন ১৯৩০ দশকের আমরা দেখতে পেয়েছি।তার সাথে সেই সময়কার আসামের উপত্যকায় বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের জীবন ধারণ থেকে তাদের চিন্তাভাবণারও বর্ননা আমরা পেয়ে যাই,আদিবাসীদের বঞ্চনার জীবন দেখেছি,সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের গল্পও জেনেছি আবার জেনেছি ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের জাঁকজমক জীবনযাত্রা।সেই সময়ে  নিজের একাকী নিঃসঙ্গ এক বালক নানা দুঃখের মাঝে নিজের  আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল সাহিত্য ও চিত্রকলায়,প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে।আর সেটাই তার মধ্যে সাহিত্যিক হবার বীজ বুনেছিল আজান্তেই।

উনার জীবনের পরবর্তী সময়ের বিরাট অংশ কলকাতায় জড়িত যা উনি উল্লেখ করেছেন সর্বশেষ খন্ডে।উনার লেখনীর মধ্যে কলকাতার বর্ননায় সেই সময়কার কলকাতা আমরা দেখতে পেয়েছি।সেই সাথে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতার পরিস্থিতি,যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার আভাস পেয়েছি।সেই সাথে উনার সেনাবাহিনীতে যোগাদান করে লাহোরে প্রশিক্ষণে গিয়ে ১৯৪০ দশকের লাহোরের বর্ননা,সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের বর্ননা,সেনাবাহিনীর জীবনযাত্রার গল্প,এক বাংগালীর অবাংগালী এলাকায় গিয়ে নিজের বাংগালীয়ানাকে ধরে রাখার গল্প পেয়েছি।এই সকল গল্পের মধ্যে কিভাবে ইংরেজরা কিভাবে  দ্বিজাতি তত্ত্ব বাস্তবায়নের বীজ বুনেছে তারও ছোট উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।

মণীন্দ্র গুপ্ত তার লেখায় কেবল নিজের জীবনের গল্পই বলেননি বরং মায়াময় স্নিগ্ধভাবে লিখেছেন সেই সময়কার ইতিহাস,জীবনযাত্রা,সাহিত্য,বিনোদনের গল্প।দেখিয়েছেন একটা মানুষের চিন্তাধারা বয়সের সাথে কিভাবে পরিবর্তন হয়।কবি মণীন্দ্র গুপ্ত অভাবনীয় পরিচিত বা জনপ্রিয় কবি ছিলেন না পশ্চিম বাংলার মতো বাংলাদেশে।কিন্তু নিজের শৈশবকে এতো নিখুঁতভাবে মনে রেখে,নিজের ভাষাশৈলী দিয়ে আত্মজীবনীকে সরল স্বীকারোক্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের নিকট জনপ্রিয় করে তুলেছেন।কবির আত্মজীবনী,রচিত কবিতাগুলো বাংগালী পাঠকের নিকট কবিকে স্মরণীয় করে রাখবে চিরকাল।

Reference:

https://www.goodreads.com/author/show/8137230.Manindra_Gupta

Comments

2 responses to ““অক্ষয় মালবেরি”- শৈশবের এক সরল স্বীকারোক্তি”

  1. NA Avatar
    NA

    Very well written review. Looking forward to read this autobiography.

  2. Rahman Avatar
    Rahman

    nice review

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *