গবেষক-লেখিকা চিত্রা দেবের বই হচ্ছে “বুদ্ধদেব কেমন দেখতে ছিলেন”। এই বইটিতে বুদ্ধদেবের জীবনী খুবই সংক্ষেপে তুলে ধরা যা খুব অল্প কথায় যারা বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস জানতে চায় তাদের কাছে অমূল্য বলে বিবেচিত হবে।
আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কলকাতা হতে ১৯৮৭ সালে এই বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়।বর্তমানে এই বইটি সংগ্রহ করা যায় কিনা সে বিষয়ে আমার ধারণা নেই।
তবে এই বইটি রিভিউ দেওয়ার ইচ্ছে হলো কেননা বুদ্ধদেবের জীবনী,বৌদ্ধধর্মের প্রচার প্রয়াস এই থেকেও বড় গৌতম বুদ্ধ দেখতে কেমন ছিলেন,কখন থেকে তার প্রতিমা তৈরিতে ভক্তদের আগ্রহ হলো,এই সকল প্রশ্ন আমাদের মনে আসতেই পারে।বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস,ব্যপ্তি এতো গভীর যে এই বিষয়ে জানার জন্যে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়।তবে আমরা যারা সংক্ষেপে বুদ্ধকে নিয়ে জানতে চাই,তাদের জন্যে কেবল ৭০(প্রথম সংস্করণ) পৃষ্ঠাতে বুদ্ধের জীবনী,বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি,প্রচারের কাহিনি থেকে বুদ্ধের প্রতিমা গড়ে তোলা এইসব কিছুই ধারণা লাভ করা যায়।বলাবাহুল্য এই বইয়ের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মকে বিস্তরভাবে জানা যাবে না নিশ্চয়ই তবে জানার আগ্রহ তৈরির জন্যে এই বইটি উল্লেখ্য হতে পারে।
বুদ্ধদেব নিজের ছবি আকা বা মূর্তি গড়া পছন্দ করতেন না।বলতেন “যে দেহ নশ্বর,দু’দিন পরে ধুলোয় মিশে যাবে তাকে ধরে রেখে কি হবে।আমার পুজো না করে প্রণাম না করে তোমরা যদি সদ্-ধর্ম পালন করে নিজেদের উন্নতি কর তাহলেই আমি সুখী হবো।”
কপিলাবস্তুর রাজা ছিলেন শুদ্ধোদন।তারই ঘরে রানী মায়াদেবীর গর্ভে জন্ম নেন সিদ্ধার্থ আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৫৬৬ বছরে।সিদ্ধার্থ নামকরণের ধারণা করা হয় করা হয় তার জন্মগ্রহণ করায় বাবা মায়ের দীর্ঘদিনের মনস্কামনা সিদ্ধ হলো বলেই।তার জন্মের পরপরই মায়াদেবী মারা যান।সিদ্ধার্থকে কোলে তুলে নিলেন তার বিমাতা মহাপ্রজাবতী গৌতমী।গৌতমীর পুত্র বলেই সিদ্ধার্থের আরেকটা নাম হলো গৌতম।আর সেই সাথে আজ পুরো বিশ্ব গৌতম বুদ্ধ হিসেবেই চিনে।
এই বইতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হতে বোধিসত্ত্ব লাভের যাত্রা থেকে জীবনের অন্তিম কালে ভিক্ষুক আনন্দের যত্নে কুশীনগরে দেহত্যাগ পর্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু গভীর তাতপর্যপূণ্য বর্ননা রয়েছে।
বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পরে সেই সময়কার রীতি অনুযায়ী দাহ্যের পরে দেহাবশেষ নিয়ে সমাধি বা স্তূপ করা হয়,সে নিয়মনীতিতে বুদ্ধের কোন আগ্রহ ছিল না।কিন্তু উনার শিষ্য ভিক্ষু আনন্দের জড়াজড়িতে উনি এই বিষয়ে আর বারণ করতে পারলেন না।গৌতম বুদ্ধ আনুমানিক বেচেছিলেন ৮০ বছর,তবু এই দীর্ঘ সময়ে কেউ বুদ্ধদেবের ছবি আকেননি,মূর্তি গড়েনি।তাকে নিয়ে লেখেছি এমন কোন বর্ণনাত্মক কাব্য যাতে তার চেহারার নিখুঁত বর্ননা পাওয়া যায়।অবশ্য বুদ্ধদেবের এইসবে আগ্রহ না থাকা,কিংবা সেই সময়ে মূর্তি গড়া বা চিত্রশিল্পের এতো ব্যবহার হয়তো ছিল এইসব কারণও হতে পারে।
বলা হয়ে থাকে উনার দাহের পরে দেহাবশেষ অর্থাৎ অস্থি,নখ,দাত এই সকল আটজন রাজা নিয়ে নিজ নিজ রাজ্যে সমাধিসৌধ তৈরি করেছিলেন।
বুদ্ধদেবের স্মৃতিরক্ষার জন্যে তার অস্থি সংগ্রহ করে এবং স্মৃতিশৌধ তৈরি সেটাকে বলা হতো “নরবু” বা অমূল্য রতন। এইসব করেই বুদ্ধভক্তরা কাটিয়ে দিলেন অনেক বছর।
হিন্দুধর্মের সাথে নতুন এই ধর্ম প্রচার কিভাবে পাল্লা দিবে এইসবের মধ্যে বৌদ্ধরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় হীনযানপন্থী অপরদল মহাযানপন্থী।হীনযানপন্থীরা মূর্তি পুজো করতেন না।মহাযানপন্থীরা মূর্তিপুজো করতেন এবং বোধিসত্ত্ব ও অন্যান্য দেবদেবী অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন।গৌতম বুদ্ধের পূর্বেও আরো বুদ্ধ এসেছেন,২৪ জন।গৌতম বুদ্ধের থেকেই জেনেছে তারা,এইসকল বিষয়ে বিশ্বাস ছিল মহাযানপন্থীদের। দুইটি দলই নিজ নিজভাবে বুদ্ধধর্মের প্রচার করতে লাগলেন।এই উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ ছিল জাত বর্ণ এইসবে মানুষের পার্থক্য করা হতো না,গৌতম বুদ্ধের শেষ সময়ে পাশে থাকা শিষ্য ভিক্ষু আনন্দকে বলা হয় চন্ডাল জাতের ছিলেন।তা নিয়ে কোনদিন বুদ্ধদেব তার সাথে ভিন্ন আচরণ করেননি।বুদ্ধদেবের এই অমায়িক আচরণ,জাত বর্ণের মাধ্যমে মানুষকে ভাগ না করাই এই উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্মকে জনসাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
বুদ্ধদেব তার উপদেশকে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে বলেছিলেন।ভিক্ষুকগণ তাই দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে যাওয়া শুরু করেন।চীনে যখন বোদ্ধ ধর্মের জোয়ার এসেছিল সেই সময়কালে মিং রাজা ৬১ খ্রিস্টাব্দে স্বপ্নে দেখেছিলেন বুদ্ধদেবকে।পন্ডিতদের পরামর্শে তিনি বুদ্ধদেবের দেশের বৌদ্ধ সাধুদের নিয়ে আসবার জন্যে দূত পাঠিয়েছিলেন।মগধ থেকে দুই পন্ডিত কাশ্যপ ও ধর্মরক্ষ চীনে যান দূতেদের সাথে ৬৫ খ্রিষ্টাব্দে।তখন থেকে চীনের সাধুরা ভারতে আসা যাওয়া শুরু করেন।
ফা-হিয়েন(ভারতে ভ্রমণের সময়কাল উনার আনুমানিক ৩৯৯-৪১৪ খ্রিস্টাব্দ)
ফাহিয়েন আসেন ভারতবর্ষে ৩৯৯ সালে আর হিউয়েন সাঙ ভারতে এসেছিলেন আনুমানিক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে।ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় বিহারে,ধর্মশিক্ষার জন্য দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসতেন।
তাদের মধ্যে ফাহিয়েন আর হিউয়েন উল্লেখযোগ্য কেননা তারা সেইসময়ের ভারতে বৌদ্ধধর্মের রীতিনীতি,জ্ঞান,ইতিহাস নিজে দেশে গিয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন।চীনাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের থেকে বেশ নিখুঁত।বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে,লিখিত ইতিহাস সংরক্ষণ না করা,বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত লেগে থাকা,পড়াশোনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চশ্রেণির নিকটই সীমাবদ্ধ থাকায়,এই উপমহাদেশে ইতিহাস চর্চা বা সংরক্ষণ সেইভাবে হয়নি।
বুদ্ধদেবের মৃত্যুর দুশো বছর পরে মগধের সিংহাসনে বসেন সম্রাট আশোক।প্রথম জীবনে তিনি খুব নিষ্ঠুর হলেও কলিংগের যুদ্ধের ভয়াবহ পরিনত দেখে তিনি শান্তির জন্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।সম্রাট আশোক নিজে হীনযানপন্থী ছিলেন,তিনি শান্তির দূত হিসেবে হীনযানপন্থী সাধুদের নানা জায়গায় পাঠালেন।সিংহলে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা গেলেন আশোক পুত্র মহেন্দ্র।এইভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রসার হতে হতে,একটা সময়ে তিব্বত,চীন,সুদূর জাপান কোরিয়াতেও বৌদ্ধদের ধর্ম পৌছে গেল।
দেবতার দেবোতম মানবের রুপে কল্পনা করেছে বৌদ্ধধর্মীয় লোকজন।তাই ভারতীয়দের মধ্যে বুদ্ধের প্রতিমায় ভারতীয় ছাপ রয়েছে,চীনাদের মধ্যে চিনাদের অবয়ব দেখা যায়।
চিত্রা দেব এর লেখা “বুদ্ধদেব কেমন দেখতে ছিলেন” বইতে কেবল উনাকে দেখতে কেমন এই প্রশ্নের উত্তরই নয় বরং কিভাবে বুদ্ধদেবের উপদেশ বাণী দূরান্তে ছড়িয়েছে,কিভাবে মানুষদের আকৃষ্ট করেছিল তারও সংক্ষিপ্ত বর্ননা আমার পেয়ে যাই।এই বইতে লেখিকা ভারতের প্রধান প্রধান বৌদ্ধ তীর্থস্থানেরর নাম ও সংক্ষেপে বর্ননা রয়েছে,এই সকল স্থানে ভ্রমণ বা তীর্থস্থানগুলো জানার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
লেখিকা চিত্রা দেব বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর লাভ করেন,পরবর্তীতে মহাভারতের উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় উনার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গবেষণা,প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে।”ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল” বইয়ের জন্যে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
Reference:
Leave a Reply